যাত্রীদের স্বার্থে সরকার কী করছে

Passenger Voice    |    ০৩:১৩ পিএম, ২০২১-১১-১৫


যাত্রীদের স্বার্থে সরকার কী করছে

জ্বালানির দাম বৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের তিনদিনের ধর্মঘটে দেশের মানুষকে ন্যক্কারজনকভাবে জিম্মি করার হলো। কিন্তু রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শহর-বন্দরগুলোতে সিটি সার্ভিস এবং দূরপাল্লার বাস আর লঞ্চ-স্টিমারের ভাড়া বাড়িয়েও এই নৈরাজ্য শেষ হয়নি। ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে প্রথম প্রশ্নটি হলো, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির অনুপাতে যাত্রীপ্রতি পরিবহনের ভাড়া কত বাড়তে পারে? দেখা যাচ্ছে, এবার ডিজেলের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ, কিন্তু বাস ও লঞ্চ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে যথাক্রমে ২৭ ও ৩৫ শতাংশ। বাস বা লঞ্চের পরিচালন ব্যয় কি শুধু তেলের দামের ওপর নির্ভর করে? চার পাঁচটা খরচের উপাদানের মধ্যে তেলের দাম মাত্র একটি; আর মোট ব্যয়ে তার অবদান কম-বেশি ৩০ শতাংশের মতো। তাহলে কি যাত্রীপ্রতি ভাড়া বৃদ্ধি জ্বালানির দামবৃদ্ধির সমানুপাতিক হতে পারে? তেলের দাম বৃদ্ধি ও পরিচালন ব্যয়ের অনুপাতে বাস পরিচালনায় ১২/১৩ শতাংশের বেশি ভাড়া বৃদ্ধি কোনোভাবেই যৌক্তিক মনে হয় না। তাহলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষ এবং নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ কীসের ভিত্তিতে এই বর্ধিত ভাড়া অনুমোদন করল? একইসঙ্গে দ্বিতীয় কিন্তু গুরুতর প্রশ্নটি হলো, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া বাড়বে কোন যুক্তিতে?

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দূরপাল্লার বাসের ভাড়া কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সার জায়গায় ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছে। আর ঢাকা, চট্টগ্রামসহ মহানগরগুলোতে বড় বাসের ভাড়া কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সার জায়গায় ২ টাকা ১৫ পয়সা এবং মিনিবাসের ভাড়া ১ টাকা ৬০ পয়সার জায়গায় ২ টাকা ৫ পয়সা করা হয়েছে। নতুন নিয়মে ঢাকায় মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৮ টাকা এবং বড় বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু মহানগরগুলোতে সিটি সার্ভিসের বাস ভাড়ার প্রধান সমস্যা হলো, কিলোমিটারপ্রতি ভাড়ার হিসাব না করে এসব পরিবহন মালিকরা ‘ওয়ে বিল’ ও ‘চেকপয়েন্ট’-এর নামে এক অদ্ভুত ব্যবস্থা জারি রেখেছে। এতে যাত্রী যে দূরত্বেই যান না কেন, তাকে একটা চেকপয়েন্ট থেকে আরেকটা চেকপয়েন্টের কোম্পানি নির্ধারিত ‘ওয়ে বিল’ বা পুরো ভাড়াই দিতে হয়। এই ব্যবস্থা বিআরটিএ অনুমোদিত নয় বরং বাস কোম্পানির মালিক পক্ষ ইচ্ছে মতো ঠিক করে নিয়েছে। এই উদ্ভট ব্যবস্থার সঙ্গে আরেকটি প্রকট সংকট হলো তথাকথিত ‘সিটিং’ ও ‘গেইট লক’ সার্ভিস। এসব নাম দিয়ে লোকাল বাসের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করা হলেও বাস্তবতা হলো নগর-মহানগরে চলাচলকারী সব বাসেই গাদাগাদি বিপুল সংখ্যক যাত্রী তোলা হয়। বিআরটিএ এখন ঘোষণা দিয়েছে, ‘সিটিং’ ও ‘গেইট লক’ সার্ভিস বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু তারা এমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না যাতে বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন বন্ধ করা যায়? অন্যদিকে, নগর-মহানগরের বাসের মতোই নৌপথে লঞ্চ-স্টিমারেও ভাড়া বৃদ্ধি করা হলেও মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন বন্ধের কোনো পদক্ষেপ নেই।

সিটি সার্ভিসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো একই রুটে বিভিন্ন কোম্পানির বাস চলাচল এবং টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলার নিয়ম বাধ্যতামূলক না করা। রাজধানী ঢাকার প্রায় কোনো বাস সার্ভিসেই এখন টিকিট দেখে যাত্রী তোলাও হয় না কিংবা বাসেও ভাড়া নিয়ে কোনো টিকিট দেওয়া হয় না। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আলাদা আলাদা কোম্পানির অনেক মালিকনির্ভর এই গণপরিবহন ব্যবস্থাই এমন বিশৃঙ্খলার অন্যতম প্রধান কারণ। দ্বিতীয় বড় কারণটি হলো, ড্রাইভার- হেলপারের কাছে দৈনিক চুক্তির ভিত্তিতে বাস পরিচালনা করা। এই কারণে ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির বাস যেমন পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাস চালায় তেমনি একই কোম্পানির আলাদা আলাদা বাসও পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। একইসঙ্গে লক্ষ করা জরুরি যে, সিটি সার্ভিস হিসেবে চলাচলকারী বাসগুলোর ৮০-৯০ শতাংশই যেমন মেয়াদোত্তীর্ণ তেমনি অত্যন্ত নোংরা এবং যাত্রীদের বসার বা দাঁড়াবারও অনুপযুক্ত। প্রশ্ন হলো, বিআরটিএ ফিটনেসহীন বাস কেন চলতে দিচ্ছে? একইসঙ্গে এই প্রশ্নও জরুরি যে, যে কোম্পানিই বাস সার্ভিস পরিচালনা করুক না কেন সব বাসের বডি-সিট-জানালা-দরজা-হাতলসহ পুরো কাঠামোর জন্য একটা কমন স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলতে কেন বাধ্য করা হচ্ছে না? সরকারি বিআরটিসি সার্ভিসের বাসগুলোকেই কেন এই স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে নেওয়া হচ্ছে না? একই কথা প্রযোজ্য নৌপথে লঞ্চ-স্টিমারের ফিটনেস এবং কাঠামো নিয়েও।

উপরোক্ত সংকটগুলো দূর করতে বিভিন্ন কোম্পানির মালিকানা বজায় রেখেই সিটি বাস সার্ভিসগুলোকে রুট অনুসারে একই ছাতার নিচে নিয়ে আসা, বাসগুলোর একই কাঠামোগত মান নিশ্চিত করা, এসব চুক্তিভিত্তিক বাস পরিচালনা নিষিদ্ধ করা এবং টিকিটের ভিত্তিতে লাইনে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলার সুপারিশ করে আসছেন দেশের গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু গণপরিবহনের ভাড়া ও ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে এমন সব নৈরাজ্য চলছে। বছরের পর বছর ধরে একের পর এক ঘটনায় সবকিছু শেষমেশ পরিবহন মালিকদের পক্ষেই যাচ্ছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে যে, যাত্রীদের স্বার্থে সরকার তাহলে কী করছে?